জিন্দাপীরের সমাধিসৌধ
জিন্দাপীরের সমাধি কমপ্লেক্স বাগের হাটের খান জাহানের সমাধির পশ্চিমে অর্ধকিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত। সম্ভবত জিন্দাপীরের প্রকৃত নাম ছিল আহমদ আলী। উত্তর দিকের দেওয়ালে তিনটি প্রবেশপথসহ ৩৩.২২ বর্গমিটার বহিঃদেওয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত কমপ্লেক্সে রয়েছে দরবেশের নিজের একগম্বুজ বিশিষ্ট একটি সমাধি, একগম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ এবং জিন্দাপীরের পরিবারবর্গের অনেকগুলি ইটের তৈরি কবর।
সমাধি সমাধিটি ইটের তৈরি। এর কাঠামো বর্গাকার। বাইরের দিকে এর প্রতি বাহুর পরিমাপ ১০.৯৭ মিটার এবং বর্তমানে এটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। সমাধি ভবনের বাইরের কোণাগুলিতে অষ্টভুজাকৃতি বুরুজ নির্মাণ করে এগুলিকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। এর ভিত্তিগুলি এখনও বিদ্যমান। সমাধির উপরিকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েছে। বর্তমানে ২.৪৪ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত সংরক্ষিত উত্তর দেওয়াল ব্যতীত অন্য তিনটি দেওয়াল, যেগুলি একসময় ভেঙ্গে পড়েছিল, সম্প্রতি মেঝের স্তর থেকে ০.৬১ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত সংস্কার করা হয়েছে। দেওয়ালগুলি মাত্র ১.৫২ মিটার পুরু।
ভবনটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দেওয়ালের প্রত্যেকটিতে তিনটি করে প্রবেশপথ আছে। অন্যদিকে উত্তরদিকের দেওয়ালে একটি খিলান পথ দেখা যায়। এ খিলানপথের উভয় পার্শ্বে রয়েছে একটি করে বড় ও গভীর খিলান কুলুঙ্গি। আদিতে ভবনটি অবশ্যই ইটের পোস্তাগুলির উপর স্থাপিত একটি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। উত্তর দেওয়ালের অভ্যন্তরে এখনও দুটি স্তম্ভ দেখা যায়।
বাঁধানো চত্বরের মাঝখানে ইটের তৈরি কবরের নিচে জিন্দাপীর সমাহিত। কবরটির পরিমাপ ৪.৮৮ মি × ৩.৬৬ মি। এর ভিত তিন ধাপ বিশিষ্ট এবং উপরের অংশ তরীতল নমুনার মতো যা খানজাহান এবং পীর আলীর সমাধিতে দেখা যায়।
ভবনটি এখন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। শুধু অলঙ্করণের নিদর্শনসমূহ এখানে সেখানে বর্তমানে সংরক্ষিত আছে। উত্তর দেওয়ালের বহিরাংশে দুটি অনুভূমিক আলঙ্কারিক বন্ধনী অঙ্কন করা হয়েছে। এগুলির প্রত্যেকটিতে আছে এক সারিবদ্ধ শীর্ষালঙ্কার যা নিকটবর্তী ছয়গম্বুজ মসজিদ (আনুমানিক পনেরো শতকের শেষার্ধে অথবা ষোল শতকের প্রথমদিকে) এবং যশোরের বারোবাজার এর গোরার মসজিদের (হোসেন শাহী আমল) মতো।
দাবি করা হয় যে, জিন্দাপীর খানজাহানের পূর্বে এখানে আসেন। কিন্তু তাঁর সমাধি ও মসজিদের বিদ্যমান স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অন্য ধারণা দেয়। কোণার বুরুজের অষ্টভুজাকৃতি, হালকা গঠনকৌশল এবং বাইরের অলংকরণ যা এ ইমারতে দেখা যায়, সেগুলি অনেক পরে দক্ষিণ বাংলার ইলিয়াস শাহী ও হোসেন শাহী আমলের স্মৃতিসৌধসমূহে প্রকাশ পেতে থাকে। তাই বর্তমান সমাধিসৌধটিকে নির্মাণ শৈলীর বিচারে পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বা হোসেন শাহী সময়ের বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
মসজিদ মসজিদটি সমাধির উত্তর পশ্চিমে এক গম্বুজবিশিষ্ট বর্গাকৃতির। ইটের তৈরি মসজিদটির পরিমাপ বাইরে থেকে কোণার অষ্টভুজ বুরুজসহ প্রতি বাহু ৭.৬২ মি এবং ভেতরে প্রতি বাহু ৪.৮৮ মি। দেওয়ালের পুরুত্ব প্রায় ১.৫২ মি। মসজিদের পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে খিলান প্রবেশপথ রয়েছে। মাঝের প্রবেশপথটি পার্শ্ববর্তী অন্য দুটি প্রবেশপথের চেয়ে বড় এবং এর বরাবরে পশ্চিম কিবলা দেওয়ালে বাইরের দিকে আয়তাকার অভিক্ষেপসহ একটি খিলান মিহরাব আছে।
ইটের তৈরি একমাত্র গম্বুজটির উপরাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। মসজিদের ভেতরে প্রতিটি দেওয়ালে স্থাপিত দুটি পোস্তা থেকে উত্থিত অর্ধ-গম্বুজাকৃতির স্কুইঞ্চগুলি গম্বুজটির ভার বহন করছে। মসজিদের কার্নিস ধ্বংস হয়ে গেছে। এর অল্প কিছু অলংকরণের নিদর্শন এখনও পড়ে আছে। কোণার অষ্টাভুজাকৃতির বুরুজগুলিতে নিয়মিত বিরতিতে আলঙ্কারিক বন্ধনী আছে। মসজিদের বহিঃগাত্রে রয়েছে উল্লম্ব অফসেট এবং কুলুঙ্গির ছোপ। নিয়মিত বিরতিতে উত্তোলিত আলঙ্কারিক বন্ধনী সজ্জিত আটটি ইটের পোস্তা গম্বুজের ভার বহন করছে।
একমাত্র মিহরাবটি প্রচলিত পোড়ামাটির ফলকে অলংকৃত। সুন্দর খাজকৃত মিহরাব কুলুঙ্গিটি একটি আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত। অর্ধ-বৃত্তাকার মিহরাব কুলুঙ্গিটি খোপ-নকশার সারি দিয়ে অলংকৃত। খোপ-নকশাগুলি খাজকৃত খিলান নকশায় সমৃদ্ধ ছিল। মিহরাবের আয়তাকার ফ্রেমটি সংঘবদ্ধকৃত কারুকার্যের নকশায় পূর্ণ ছিল। ফ্রেমটির উপরের অংশের উপরে অঙ্কিত ছিল এক সারি বদ্ধ পাপড়ি।
পার্শ্ববর্তী সমাধির সাথে মসজিদটির নির্মাণ শৈলীর সাদৃশ্য রয়েছে। তাই এ মসজিদটিকেও ওই একই সময়ের পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বা হোসেনশাহী আমলের তৈরি বলে ধরে নেওয়া উচিত